সিরিয়া সম্পর্কে যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন মহানবী (সা.) 

  • ধর্মচিন্তা ডেস্ক | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৯, ২০২৪, ০৬:২৯ পিএম
সিরিয়া সম্পর্কে যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন মহানবী (সা.) 

ঢাকা : গতকাল সিরিয়ার জালেম শাসক বাশার আল আসাদের পতন হয়েছে। তিনি সিরিয়া ছেড়ে পালিয়েছেন। সিরিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা দামেস্ক থেকে সরে গেছেন। গতকাল সেখানে সেনা প্রত্যাহার করা হয়েছে। তাই রাজধানী দামেস্কের রাস্তায় নেমে উল্লাস করেন বিদ্রোহী গোষ্ঠীরা। রাস্তায় নেমে আসেন হাজার হাজার মানুষ। তাদেরও উল্লাস করতে দেখা যায়। তারা ‘আসাদ পালিয়ে গেছেন’, ‘হোমস মুক্ত’ এবং ‘সিরিয়া দীর্ঘজীবী হোক’ বলে স্লোগান দেন। পৃথিবীর প্রাচীন সভ্যতা ও সংস্কৃতির দেশ সিরিয়া। এই অঞ্চলটি ইসলামপূর্ব যুগ থেকেই গুরুত্বপূর্ণ। এই ভূমিতে জন্মগ্রহণ করেছেন অংখ্য নবী। তারা বসবাসও করেছেন এখানে। হজরত ইব্রাহিম (আ.) নিজ সম্প্রদায়ের বিরোধিতার মুখে পড়ে আল্লাহর আদেশে সিরিয়া ভূমিতে হিজরত করেন। এখানে জন্মগ্রহণ করেন ঈসা (আ.)।

হজরত মুসা (আ.) হিজরত করে আগমন করেছিলেন এখানে। সিরিয়া তৎকালীন সময়ে শাম বলে পরিচিত ছিল। বর্তমান সিরিয়া, ফিলিস্তিন, লেবানন, জর্দান সবই এই শাম ভূমির অন্তর্ভুক্ত। এই শামের সঙ্গে ভবিষ্যতের ও কেয়ামতপূর্ব অনেক ঘটনাও জড়িত রয়েছে। এখানে ইমাম মাহাদির হাতে বায়আত, ঈসা (আ.)-এর আগমন, দাজ্জালের হত্যাসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সংঘটিত হবে বলে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন রাসুলুল্লাহ (সা.)। কিছু বরকতপূর্ণ ও পবিত্র ভূমির উল্লেখ রয়েছে হাদিসে। এর মধ্যে সিরিয়াও রয়েছে। দেশটি ইতিহাসের অগণিত ঘটনার সাক্ষী। বর্তমান সিরিয়া, জর্দান, লেবানন ও পূর্ণ ফিলিস্তিন হচ্ছে প্রাচীন শাম রাজ্য বা মুলকে শাম। এই অঞ্চলকে বলা হয় নবী-রাসুলদের ভূখণ্ড। এই শামের সঙ্গে ভবিষ্যতের ও কেয়ামতপূর্ব অনেক ঘটনাও জড়িত রয়েছে। রাসুলুল্লাহ (স.) শামের ব্যাপারে বিভিন্ন ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। এ বিষয়ে হাদিসের বিবরণী উল্লেখ করা হলো। আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসুল (সা.)-কে বলতে শুনেছি, হিজরতের পর আরেকটি হিজরত দ্রুতই সংঘটিত হবে। তখন ভূপৃষ্ঠের সর্বোৎকৃষ্ট মানুষ হবে তারাই, যারা ইব্রাহিম (আ.)-এর হিজরত ভূমিতে (শাম দেশে) অবস্থান করবে। আর গোটা পৃথিবীতে সর্ব নিকৃষ্ট মানুষরাই অবস্থান করবে। তাদের ভূমিগুলো তাদের নিক্ষেপ করবে।

আল্লাহ তাদের অপছন্দ করবেন। তাদের ফেতনার আগুন বানর ও শূকরের সঙ্গে মিলিয়ে রাখবে (তাদের দুশ্চরিত্রের কারণে তারা যেখানেই যাবে, সেখানেই ফেতনা লেগে থাকবে)। (আবু দাউদ) ইবনে হাওয়ালা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ইসলামি বাহিনী শিগগিরই কয়েকটি দলে দলবদ্ধ হবে। একটি দল শামে, একটি ইয়েমেনে ও অন্য একটি ইরাকে। ইবনে হাওয়ালা (রা.) জিজ্ঞেস করেন, হে আল্লাহর রাসুল! আমি যদি সেই যুগ পাই, তাহলে আমি কোন দলটিতে যোগদান করব, তা বলে দিন। রাসুল (সা.) বলেন, তুমি শামের বাহিনীতে থাকবে, কেননা তা আল্লাহর পছন্দনীয় ভূমির একটি, সেখানে তিনি তার সর্বোৎকৃষ্ট বান্দাদের একত্র করবেন। যদি তুমি তাতে যোগদান না করো, তাহলে তুমি ইয়েমেনের বাহিনীকে গ্রহণ করো। আর তোমরা শামের কূপ থেকে পানি গ্রহণ করো। কেননা আল্লাহ আমার জন্য অর্থাৎ আমার উম্মতের জন্য শাম ভূখণ্ড ও তার বাসিন্দাদের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। (আবু দাউদ) শুরাইহ ইবনে উবাইদ (রহ.) বলেন, হজরত আলী (রা.) ইরাকে অবস্থানরত অবস্থায় তাকে শামবাসীদের ব্যাপারে বলা হলো, আপনি তাদের ওপর অভিশাপ করুন! তখন তিনি বলেন, না, আমি রাসুল (সা.)-কে বলতে শুনেছি, শাম ভূখণ্ডে আবদালরা (আল্লাহর ওলিদের বিশেষ দল) থাকেন, তারা ৪০ জন থাকেন, যখনই তাদের থেকে একজন মারা যান, আল্লাহ তার স্থানে অন্য একজনকে রাখেন। তাদের বরকতে বৃষ্টি হয় এবং শত্রুর ওপর জয়লাভ হয়। ভবিষ্যতে তাদের অসিলায় শামবাসীদের থেকে আজাব উঠিয়ে নেওয়া হবে। (মুসনাদে আহমদ) মুয়াবিয়া ইবনে কুররা (রা.) সূত্রে বর্ণিত, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, যখন শামভূমি ফাসাদ সৃষ্টিকারীদের দ্বারা ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে, তখন তোমাদের মধ্যেও কোনো কল্যাণ থাকবে না। আর আমার উম্মতের একটি দল সর্বদা সাহায্যপ্রাপ্ত হবে, তাদের যারা ক্ষতি করার চেষ্টা করবে, তারা কেয়ামত পর্যন্ত তাদের ক্ষতিসাধন করতে পারবে না। (জামে তিরমিজি) হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, মহাযুদ্ধের সময় মুসলিমদের ছাউনি হবে ‘গোতা’ শহরে, যা দামেস্ক শহরের পাশে অবস্থিত।

এটি শামের উৎকৃষ্ট শহরগুলোর একটি। (আবু দাউদ) অন্য বর্ণনায় এসেছে, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, অচিরেই তোমরা শাম বিজয় করতে পারবে, যখন তোমাদের সেখানে বসবাসের এখতিয়ার দেওয়া হবে, তোমরা দামেস্ক নগরীকে বাসস্থান বানাবে। কেননা তা যুদ্ধকালীন মুসলিমদের আশ্রয়স্থল হবে। আর তাদের ছাউনি হবে সেই দেশের একটি ভূমি, যাকে ‘গোতা’ বলা হয়। (মুসনাদে আহমদ) আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, খোরাসান ভূমি থেকে কালো পতাকাবাহী দল বের হবে, তাদের কোনো কিছুই রুখতে পারবে না, যতক্ষণ না তারা তা ‘ইলিয়া’ তথা জেরুজালেমে স্থাপন না করে। (জামে তিরমিজি) যুগে যুগে সেই আব্বাসীয় খেলাফতের শুরুর লগ্ন থেকে অনেকেই নিজেদের ওই দল বোঝানোর জন্য কালো পতাকা নিয়ে অভিযানে নেমেছে। কেউ বা নিজেকে ইমাম মাহদিও দাবি করে বসেছে। এসব নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। বরং ওই দলের ব্যাপারে নিশ্চিতভাবে আল্লাহই ভালো জানেন, তারা কোন যুগের ও কারা হবে।

উম্মে সালামা (রা.) সূত্রে বর্ণিত, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, মুসলমানদের একজন খলিফার ইন্তেকালের পর মতানৈক্য হবে। তখন মদিনাবাসীর একজন ব্যক্তি (মতানৈক্য এড়িয়ে যাওয়ার জন্য) মক্কায় চলে আসবেন। অতঃপর মক্কাবাসী অনেক লোক তার কাছে আসবে এবং তাকে তার অনিচ্ছা সত্ত্বেও ঘর থেকে বের করে এনে মাকামে ইব্রাহিম ও হাজরে আসওয়াদের মধ্যবর্তী স্থানে তার হাতে বাইয়াত হবে। (তিনিই হলেন ইমাম মাহদি) তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য শাম থেকে একটি (বাতেল) দলকে পাঠানো হবে। তবে তারা মক্কা-মদিনার মধ্যবর্তী বাইদা নামক স্থানে পৌঁছলে ভূমিধসে আক্রান্ত হবে। উম্মে সালামা (রা.) বলেন, আমি জানতে চাইলাম, হে আল্লাহর রাসুল! তাদের মধ্যে যদি কেউ এমন হয় যে, সে এই দলে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেনি; বরং তাদের জোরপূর্বক নেওয়া হয়েছে, তাদেরও কি এ শাস্তি দেওয়া হবে? তখন রাসুল (সা.) ইরশাদ করলেন, হ্যাঁ, সবাই ভূমিধসে পতিত হবে, যদিও কেয়ামতের দিন যার যার নিয়তের ওপর ফায়সালা করা হবে। (সহিহ মুসলিম) যখন মানুষ তা দেখবে, তখন ইমাম মাহদির কাছে শামের আবদালরা ও ইরাকের উৎকৃষ্ট মানুষের দল আসবে। অতঃপর তারা মাকামে ইব্রাহিম ও হাজরে আসওয়াদের মধ্যবর্তী স্থানে তার হাতে বাইয়াত হবে। অতঃপর কুরাইশ বংশের জনৈক ব্যক্তির উদ্ভব হবে, কালব গোত্র হবে তার মাতুল গোত্র। সে তাদের মোকাবিলায় একটি বাহিনী পাঠাবে। যুদ্ধে ইমাম মাহদির অনুসারীরা কালব বাহিনীর ওপর বিজয়ী হবে। এ সময় যারা কালবের গনিমত নিতে উপস্থিত হবে না, তাদের জন্য আফসোস! মাহদি গনিমতের সম্পদ বণ্টন করবেন এবং নবী (সা.)-এর সুন্নত অনুযায়ী মানুষের মধ্যে কার্য পরিচালনা করবেন। আর ইসলাম সারা পৃথিবীতে প্রসারিত হবে। অতঃপর তিনি সাত বছর অবস্থান করার পর মারা যাবেন। আর মুসলিমরা তার জানাজার নামাজ পড়বে। ইমাম আবু দাউদ (রহ.) বলেন, কেউ কেউ হিশাম থেকে বর্ণনা করে বলেন, ৯ বছর অবস্থান করবেন। (মুসতাদরাকে হাকেম) নাউওয়াস ইবনে সামআন (রা.) সূত্রে বর্ণিত, একটি হাদিসে দাজ্জাল সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘দাজ্জাল ইরাক ও শামের মধ্যবর্তী এলাকা থেকে বের হবে এবং ডানে-বাঁয়ে গোটা পৃথিবীতে ফাসাদ সৃষ্টি করতে থাকবে। তাই হে আল্লাহর বান্দারা! তোমরা ইমানের ওপর অটল থাকবে।’ দীর্ঘ হাদিস বর্ণনার একপর্যায়ে নবী (সা.) বলেন, দীর্ঘ ৪০ দিন ধরে দাজ্জালের অনিষ্টতার পর আল্লাহ ঈসা (আ.)-কে পাঠাবেন। তিনি দামেস্কের পূর্ববর্তী এলাকার শুভ্র মিনারের কাছে আসমান থেকে দুজন ফেরেশতার কাঁধে চড়ে অবতরণ করবেন। তখন তার শ্বাস-প্রশ্বাস যে কাফেরের গায়ে লাগবে, সে মারা যাবে। আর তার দৃষ্টিসীমার শেষ প্রান্তে গিয়ে তার শ্বাস-প্রশ্বাস পড়বে। তিনি দাজ্জালকে তালাশ করবেন। অতঃপর শামের বাবে লুদ নামক স্থানে তাকে হত্যা করবেন। (সহিহ মুসলিম)

লেখক : মাওলানা রফিকুল ইসলাম

এমটিআই

Link copied!